নৌ দুর্ঘটনার কারণ
*ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশের সমুদ্র ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন প্রশ্ন উঠেছে। নৌ দুর্ঘটনা দেশে নিয়মিত ঘটনা। প্রতি বছরই এমন দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। নিয়মিত মামলা রয়েছে। কিন্তু মামলা নিষ্পত্তির তেমন রেকর্ড নেই।
এ ধরনের ঘটনা এড়াতে কিছু তদন্ত কমিটি কিছু সুপারিশও করে থাকে। কিন্তু পরে তা খুব একটা বাস্তবায়িত হয় না। এদিকে, নিয়মিত বিরতিতে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। কেন নৌপথে এই সব দুঃখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে? এ প্রশ্নে নৌ-বিশেষজ্ঞ ও খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, নৌযানের ফিটনেসের অভাব, খারাপ আবহাওয়া ও অযোগ্য পাইলটদের কারণে প্রতিনিয়ত নৌ দুর্ঘটনা ঘটছে।
*ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ নামের একটি লঞ্চে শুক্রবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এ পর্যন্ত ৪১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আরো অনেকে নিখোঁজ রয়েছে বলে দাবি করছেন স্বজনরা।
যাত্রীবাহী লঞ্চ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন: "এই ঘটনা তাদের নতুন করে ভাবিয়েছে৷
এখন বড় প্রশ্ন হল কেন এমন হল। কারণ জানতে পারে সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি। এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে কী করা হবে। এরপর তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে মালিক সমিতি।
*মাহবুব উদ্দিন আহমেদ অবশ্য দাবি করেন, ‘সরকার ও মালিকপক্ষের নানা উদ্যোগের কারণে সম্প্রতি দুর্ঘটনা কমেছে।
*বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, তাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, তারা বেশ কিছুদিন ধরে কমিটিতে রয়েছেন। তারা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, "নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় নৌ পরিবহনের নিরাপত্তা নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন, ততটাই তাদের নবায়ন ও নিবন্ধন ফি পরিশোধের বিষয়ে। সে কারণেই জাহাজ দুর্ঘটনার সংখ্যা কমছে না।"
*নৌপরিবহন অধিদপ্তরের জাহাজ জরিপ কর্মকর্তা মো. মঞ্জুরুল কবির বলেন, "দুর্ঘটনা ঘটলে একাধিক তদন্ত কমিটি কাজ করে। তদন্ত প্রতিবেদনে যারা দোষী সাব্যস্ত হয় তাদের বিচার করা হয়। তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কাজ করেন। পরে আদালতে মামলার রায় হয়। অধিদপ্তরের কিছুই নেই। এখানে করতে হবে।"
*ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন বলেন: "সর্বশেষ ঘটনাটি এ ধরনের প্রথম দুর্ঘটনা। এটি অবশ্যই আমাদের জন্য একটি বড় দুর্ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা রোধে আমাদের সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হবে। ভবিষ্যত।"
*যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছর প্রায় ৩০টি বড় নৌ দুর্ঘটনা এবং প্রায় ৩০০টি মাঝারি ও ছোট দুর্ঘটনা ঘটেছে। বেসরকারি কোম্পানি কোস্ট বিডির এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত ২০ বছরে বাংলাদেশের নৌপথে ১২টি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে দেড় হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সবচেয়ে বড় লঞ্চ ডুবির দুর্ঘটনা ঘটেছে মেঘনা নদীতে।
*বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নৌ দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০০৩ সালে। ওই বছরের ৮ জুলাই ঢাকা থেকে ভোলাগামী এমভি নাসরিন-১ নামের লঞ্চটি চাঁদপুরের মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় ডুবে যায়। বিআইডব্লিউটিএ বলছে, উপচে পড়া ভিড় ও মালামালের কারণে লঞ্চটির মেঝে ফেটে যায়। কর্মকর্তারা বলছেন, এক হাজারের বেশি যাত্রী নিয়ে ডুবে যাওয়া লঞ্চটিতে ৫০০ যাত্রী হারিয়েছে। তবে স্থানীয় সূত্রের দাবি, দুর্ঘটনায় ছয় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, নৌপথে এটাই সবচেয়ে বড় প্রাণহানির ঘটনা।
২*০০২ সালের ৩ মে চাঁদপুরের সাতনাল সংলগ্ন মেঘনা নদীতে সালাহউদ্দিন-২ নামের একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবে যায়। তখন ভোলা ও পটুয়াখালীর প্রায় ৪০০ যাত্রী মারা যান বলে দাবি করা হয়। দুর্ঘটনার পর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি পরিকল্পনা অনুযায়ী লঞ্চ নির্মাণ না করায় অতিরিক্ত যাত্রী বহনের জন্য মালিক ও কর্তাকে দায়ী করে। লঞ্চের মালিককে জরিমানা ও মাস্টারকে চাকরিচ্যুত করা হলেও অন্যদের শাস্তি হয়নি।
২০১৪ সালের ৪ আগস্ট আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে পদ্মা নদীতে পিনাক-৬ নামের একটি লঞ্চ ডুবে যায়। পরে লঞ্চটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছেন প্রায় ৫০ জন যাত্রী।
গত বছরের ২৯ জুন বুড়িগঙ্গা নদীতে এমভি ময়ূর-২ যাত্রীবাহী লঞ্চ 'এমএল মর্নিং বার্ড' ডুবে ৩৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। দুর্ঘটনার দিন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। পরে ওই বছরের ৮ জুলাই নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা এড়াতে ২০ দফা সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এসব সুপারিশের বেশির ভাগই এক বছরে বাস্তবায়িত হয়নি।
চলতি বছরের ৩ মে মাদারীপুরের শিবচরের কাঁঠালবাড়ী ঘাটের কাছে পদ্মা নদীতে নোঙর করা একটি বাল্কহেডের সঙ্গে স্পীডবোটের ধাক্কায় ২৮ যাত্রী নিহত হন।
চলতি বছরের ৪ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ শহরের কয়লাঘাট এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে এমএল সাবিত আল হাসান নামের একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবে অন্তত ৩৪ জন নিহত হন।
29 জুন, 2020 ঢাকার পোস্তগোলার কাছে বুড়িগঙ্গায় মর্নিং বার্ড নামে একটি লঞ্চ ডুবির ঘটনা ঘটে। ওই দুর্ঘটনায় অন্তত ৩৩ জন নিহত হয়।
২০০০ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঈদুল আজহার রাতে চাঁদপুরের মতলব উপজেলার সাতনাল এলাকায় মেঘনা নদীতে এমভি জলকপট ও এমভি রাজহাঁসি নামের দুটি যাত্রীবাহী লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। রাজহাঁস লঞ্চটি ডুবে গিয়ে ১৮২ যাত্রী নিহত হয়।
0 Comments